শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান: বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রনায়ক।
বাংলাদেশের হৃদয় কমল শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান (বীর উত্তম) আমাদের জাতীয় ইতিহাসের ঐতিহাসিক ও অনিবার্য চরিত্র। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের সূচনাকালে তাঁরই কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছিল আমাদের প্রথম রণধ্বনি ‘উই রিভোল্ট’। রাজনৈতিক নেতৃত্বশূন্য দেশে চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে দিশেহারা জাতিকে আশার আলো দেখিয়েছিলেন জিয়াউর রহমান।
শুধু তাই না, রণাঙ্গনে সেক্টর কমান্ডার এবং জেড ফোর্সের অধিনায়ক হিসেবে বীরোচিত ভূমিকা রেখেছিলেন মেজর জিয়াউর রহমান। সেই সাহসিকতাপূর্ণ ভূমিকার জন্য স্বাধীনতার পর ‘বীর উত্তম’ খেতাবে ভূষিত হন তিনি।
স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগের অজস্র ভুল পদক্ষেপ ও দুঃশাসন দেশের মানুষের মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে পদদলিত করেছিল। ভুল নীতির মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিকে পঙ্গু করে ফেলেন শেখ মুজিব। সমাজতন্ত্রের নামে অপরিকল্পিতভাবে বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের মাধ্যমে সেগুলোকে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের লুটপাটের আখড়ায় পরিণত করা হয়। দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নির্মূলের মতো জঘন্য জিঘাংসার মাধ্যমে শেখ মুজিব একজন বর্বর স্বৈরশাসকে পরিণত হন। আওয়ামী লীগের অনুসারীদের অব্যাহত লুটপাট-দুর্নীতির কারণে সাড়ে সাত কোটি মানুষের নাভিশ্বাস ওঠে। ১৯৭৪ সালে দুর্ভিক্ষে লাখ লাখ মানুষ মারা যায়। অবস্থা বেগতিক দেখে দুঃশাসন দীর্ঘায়িত করতে শেখ মুজিবুর রহমান গণতন্ত্রকে কবর দিয়ে কুখ্যাত বাকশাল প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ নেন।
পাকিস্তানি শাসনামলে আমাদের জনগণের মনে যে গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছিল, বাকশালের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশকে তার বিপরীতে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন শেখ মুজিব। এমন প্রেক্ষাপটে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট আওয়ামী লীগেরই একটি অংশের সমর্থনে সেনা সদস্যদের হাতে সপরিবারে নিহত হন শেখ মুজিব। এর পরবর্তী ঘটনা প্রবাহে, অভ্যুত্থান আর পাল্টা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশারফ এবং কর্নেল (অফ.) তাহেরের মধ্যে ক্ষমতা দখলের রক্তাক্ত দ্বন্দ্বে বিরক্ত সিপাহী জনতার বিপ্লবের মধ্য দিয়ে সামনে চলে আসেন স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে কিংবদন্তী হয়ে ওঠা সততা ও প্রজ্ঞায় তুমুল জনপ্রিয় সেনানায়ক জিয়াউর রহমান। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর ঐতিহাসিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে তাঁকে ক্ষমতার কেন্দ্রে নিয়ে আসে বিপ্লবী সিপাহী-জনতা। স্বাধীনতার ঘোষক জিয়াউর রহমান যখন বাংলাদেশের হাল ধরেন, তখন বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে ভঙ্গুর, সাংবিধানিকভাবে একদলীয় এবং রাজনৈতিকভাবে টালমাটাল এক জনপদ। দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব অক্ষুণ্ণ রাখার চ্যালেঞ্জও ছিল।
একজন রাষ্ট্রনায়কের মতো নেতৃত্ব দিয়ে দেশের অর্থনীতিকে শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করান জিয়াউর রহমান। তাঁর হাত ধরে বাংলাদেশ প্রবেশ করে বিশ্ব পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থায়। বিদেশে জনশক্তি পাঠিয়ে দেশের বেকারত্ব কমানো ও একইসঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রা আয় এবং তৈরি পোশাক শিল্পের গোড়াপত্তন করেন জিয়াউর রহমান। এই দুটি খাত এখনো বাংলাদেশের অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক। জিয়াউর রহমানের সুচিন্তিত পদক্ষেপে দেশের বেসরকারি খাত বিকশিত হওয়া শুরু হয়। দুর্নীতিবাজেদের বিরুদ্ধে জিয়াউর রহমানের ছিল কঠোর অবস্থান। তার নিজের জীবনও ছিল সততা ও শৃঙ্খলার বন্ধনীতে ঘেরা। জিয়াউর রহমানের নানা অভিনব পদক্ষেপে দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়িয়েছিল। সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডকেও তিনি ব্যাপক উৎসাহ দেন। বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ‘নতুন কুঁড়ি’ শুরু হয়েছিল জিয়াউর রহমানের সময়ে।
সংবিধান সংশোধন করে শেখ মুজিবের প্রণীত একদলীয় শাসনের পরিবর্তে বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছিলেন জিয়াউর রহমান। সশস্ত্র বাহিনীতে দ্রুত শৃঙ্খলা ফেরাতে নানা পদক্ষেপ নিয়েছিলেন; বলিষ্ঠ নেতৃত্বে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটিয়েছিলেন। দেশের সব মানুষকে অন্তর্ভুক্ত ও ঐক্যবদ্ধ করতে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের ধারণাকে সামনে আনেন বীর উত্তম জিয়াউর রহমান।
দেশের বাইরে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে বাংলাদেশকে মর্যাদার আসনে নিয়ে গিয়েছিলেন জিয়াউর রহমান। বিভিন্ন রাষ্ট্রের সাথে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন তিনি। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতা জোরদার করতে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠার চিন্তা করেছিলেন জিয়াউর রহমান। জিয়াউর রহমানের সেই চিন্তাকে ধারণ করেই পরে সার্ক প্রতিষ্ঠিত হয়। জিয়াউর রহমান নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রনায়ক। কারণ তিনিই প্রথম শাসক, যিনি বাংলাদেশকে একটি আত্মমর্যাদাশীল রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরতে পেরেছিলেন। যারা চায়নি বাংলাদেশ একটি সমৃদ্ধ রাষ্ট্র হিসেবে পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াক, তাদের ষড়যন্ত্রে ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে দেশদ্রোহী ও বিভ্রান্ত একদল সেনাসদস্যের হাতে শহীদ হন স্বাধীনতার ঘোষক জিয়াউর রহমান।
দেশের জন্য নিজের মহৎ চিন্তাভাবনাগুলোর আলোকে বাংলাদেশকে গড়ে তুলতে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) প্রতিষ্ঠা করেছিলেন জিয়াউর রহমান। এই দলটি গত সাড়ে ১৫ বছর গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করেছে। এই সংগ্রামে বিএনপির বহু নেতা-কর্মী স্বৈরাচার শেখ হাসিনার গণতন্ত্রবিধ্বংসী থাবায় শহীদ হয়েছেন, অনেকে গুম হয়েছেন, পঙ্গুত্ববরণ করেছেন অসংখ্য। বিএনপিকে ভাঙার জন্য নানা ছলচাতুরি করেও ভাঙতে পারেনি স্বৈরাচার হাসিনা। সর্বশেষ জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানেও বিএনপির ৪২২ জন নেতা-কর্মী শহীদ হয়েছেন।
নির্মম নির্যাতন-নিপীড়ন, শেখ হাসিনার নির্মূলের রাজনীতির বিপরীতেও যে বিএনপি টিকে ছিল, তার প্রধান কারণ শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আদর্শের প্রতি অবিচল আস্থা। ক্রান্তিকালে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে দিশেহারা মানুষকে উজ্জীবিত করা, দেশের দায়িত্ব নেওয়ার পর দূরদর্শী পদক্ষেপে দেশের অর্থনৈতিক বিকাশের সূচনা, বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং দেশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের প্রবর্তন- এসব ঐতিহাসিক অবদান শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে বাংলাদেশের মানুষের জন্য একজন প্রাতঃস্মরণীয় মহিরূহে পরিণত করেছে। দেশের প্রথম রাষ্ট্রনায়ককে জানাই সশ্রদ্ধ সালাম।
নাছির উদ্দীন নাছির, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল