মানববন্ধনের ছবি
আজ শুক্রবার (২৫ এপ্রিল,২০২৫) জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে শহর ও গ্রামে বিনামূল্যে পানি সরবরাহ করার দাবিতে আয়োজিত সমাবেশে এ কথা বলেন, বিশিষ্ট কবি, দার্শনিক ও রাষ্ট্রচিন্তক ফরহাদ মাজহার।
এসময় তিনি আরো বলেন, আজ আমরা যারা জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নানাভাবে অংশগ্রহণ করেছি এবং জনগণের অভিপ্রায়কে পূর্ণতা দেবার জন্য লড়ে যাচ্ছি তারা সকলে মিলে সুপেয় পানি নিশ্চিত করবার লড়াই শুরু করেছি। আমরা চাই অবিলম্বে পানির বাণিজ্যিকীকরণ বন্ধ করে পানিকে গণসম্পদ হিশাবে ঘোষণা করা হোক। পানি মানেই জীবন। ল্যাটিন আমেরিকার জনগণ পানির জন্য যুদ্ধের লড়াইয়ে রণধ্বনি দিয়াছিল যে জাতি পানি বেচে, সেই জাতি আসলে জীবন বিক্রি করে, তারা তাদের মানুষগুলোকে বাজারে বেচাবিক্রি করতেও দ্বিধা করে না। আমরা চাই নিষ্ঠুর ও নির্দয় কাছাখোলা বাজার ব্যবস্থার অবসান হোক।
জাতিসংঘ ২০১০ সালে স্বীকার করেছে যে পানি একটি মৌলিক মানবাধিকার। এটিকে বাণিজ্যিক পণ্য হিসেবে চালিয়ে দিলে দরিদ্র মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার লংঘন করা হয়। সরকারকে অবশ্যই নদীর, মাটির তলা ও বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ এবং পানি দূষণ রোধ করতে হবে। পানি বিষাক্ত করা রোধ করতে হলে অবিলম্বে বিষ ও ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থের ব্যবহার নিষিদ্ধ এবং নদী ও সমুদ্রে বর্জ্য নিক্ষেপ বন্ধ করতে হবে। অবিলম্বে শক্তিশালী বর্জ্যব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হবে।
পানির ওপর জনগণের সামষ্টিক মালিকানা প্রতিষ্ঠা এবং প্রতিটি নাগরিকের জন্য সুপেয় পানি নিশ্চিত করার সঙ্গে গণতন্ত্রের সম্পর্ক রয়েছে। গণতন্ত্র মানে ভোটাভুটি ও লুটেরা ও মাফিয়া শ্রেণীকে ক্ষমতায় বসানো না, বরং গণসার্বভৌমত্ব (People’s Sovereignty) কায়েম করা। জুলাই গণঅভ্যুত্থান জনগণকে এই শিক্ষা দিয়েছে। গণসার্বভৌমত্ব কায়েম মানে জনগণের সামষ্টিক অভিপ্রায় বাস্তবায়ন। এই অভিপ্রায়ের অতি প্রাথমিক দাবি হচ্ছে সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকা। প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর জনগণের সামষ্টিক মালিকানা ও অধিকার কায়েম ছাড়া তা অর্জন সম্ভব নয়। অতএব সুপেয় পানির অধিকার নিশ্চিত করা জনগণের সামষ্টিক অভিপ্রায়েরই অন্তর্গত। অতএব ২০/ ৩০ টাকা দিয়ে প্লাস্টিকের বোতলে পানি কিনে খাওয়ার দুষ্ট বাজারি নীতির অবসান ঘটাতে হবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে অবিলম্বে শহরে, গ্রামে সর্বত্র সুপেয় পানি রক্ষা এবং সুপেয় পানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। বাঁচামরার এই গোড়ার কথা আজ আমরা সকলে মিলে সরকারের কাছে পেশ করেছি। আশা করি সরকার আমাদের আবেদন শুনবেন।
পানি পানি পানি চাই — শহিদ মুগ্ধসহ আমরা আমাদের শহিদদের ভুলিনি। যারা অঙ্গ প্রত্যঙ্গ হারিয়ে বেঁচে আছেন তাঁদের কাছে আমাদের দায় আছে। সুপেয় পানির সরবরাহ নিশ্চিত করা অতি প্রাথমিক একটি পরীক্ষা যার দ্বারা আমরা অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে জনগণের সম্পর্কের চরিত্র বুঝব।
সরকার অবশ্যই জানেন যে জাতিসংঘের SDG-6 (টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য) অনুযায়ী, সকলের জন্য নিরাপদ ও সাশ্রয়ী মূল্যে পানির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে সরকার বাধ্য। সুপেয় পানি সরবরাহে বৈষম্য হলে দরিদ্র বা প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে যে শহর ও গ্রামাঞ্চলে সমানভাবে পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। পানি পাওয়া প্রতিটি নাগরিকের অধিকার।
আমরা আসলে শহরের অতি সাধারণ মেহনতজীবী জনগণের কথা সরকারকে মনে করিয়ে দিয়েছি। আমরা পানিকে ব্যক্তিগত মালিকানাধীন করাকে প্রাণ ও প্রকৃতি বিধ্বংসী নীতি এবং মানিবাধিকার লংঘন মনে করি। কারণ পানি জীবনধারণের মৌলিক উপাদান। বাতাসের মতো পানি প্রকৃতির দেওয়া সাধারণ সম্পদ (Commons)। বাতাস ও পানি ছাড়া মানুষ বেঁচে থাকতে পারে না। প্রাকৃতিক সম্পদ মানে বাজারের পণ্য নয়। কোনো ব্যক্তি বা কর্পোরেশন এই সম্পদকে মুনাফার জন্য প্রাইভেটাইজ করলে তা প্রাণঘাতী হয়, কারণ পানি ছাড়া মানুষ মাত্র ৩ দিন বাঁচতে পারে।
পানি “পণ্য” নয়, পানি জীবনের ভিত্তি। পানি বেসরকারিকরণ করা মানে মানবাধিকার লংঘন, প্রকৃতির ধ্বংস, এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য বৃদ্ধি। অতএব গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও স্থানীয় সরকার বা স্থানীয় জনগণের হাতে পানির নিয়ন্ত্রণ থাকলে তা ন্যায্য বণ্টন, পরিবেশ সুরক্ষা এবং টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করে।